উপহার "স্মৃতির মানুষ" বুক শেলফ থেকে বইটা হাতে নিতেই চোখের সামনে স্মৃতিগুলো স্বচ্ছ আয়নার মতো ভাসতে লাগলো। নীলাদ্রির দেয়া প্রথম বই উপহার। গত বছর একুশে বই মেলা থেকে আমাকে সাথে নিয়েই কিনেছে। বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় লিখা- 'প্রতিবছর তোমার বউ হয়ে তোমার সাথে মেলায় আসতে চাই'। একবছর গত হয়েছে। মেয়েটা অপেক্ষা করেই যাচ্ছে। বউ এখনো হতে পারেনি। তবে আমার জীবনে অনেকটা জুড়ে দখল করে আছে। যতোটা দখল করলে সম্পত্তির মালিক হওয়া যায়, তার দখলদারিত্ব তার চেয়ে ঢের বেশি। মহামারীর কারণে গতবছর বই মেলা শুরু হয় ১লা মার্চ। আমরা বই মেলায় যাই মার্চের শেষ সপ্তাহের দিকে। তার তিন-চার দিন আগেই নীলাদ্রি ঢাকায় আসে। আসার পর থেকেই তাকে নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি। সারা বিকেল মেলায় ঘুরাঘুরি করলাম। বড় বেলায় এটাই তার প্রথম বই মেলায় আসা। সন্ধ্যা হওয়ার আগ মুহুর্তে আমি আর নীলাদ্রি বসলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লেকের পাড়। এ পাশ থেকে মেলাকে ক্যানভাসে আকাঁ ছবির মতো সুন্দর দেখায়। দু'জন লেকে পা ভিজিয়ে বসে রইলাম। হঠাৎ নীলাদ্রি বললো পুরো ফেব্রুয়ারী মাস জুড়ে এতো গুলো দিবস গেল তুমি কখনো উইশ করলে না। সব বাদ দিলাম, ভালোবাসা দিবসে অন্তত উইশ করতে পারতে। পহেলা ফাল্গুনের শুভেচ্ছা জানাতে পারতে। আমি চুপ করে রইলাম। মনোযোগ চলে গেল লেকের পানিতে ডুবে থাকা নীলাদ্রির পায়ের দিকে। অনেক গুলো ছোট ছোট মাছ তার পায়ের চারপাশে ঘুরাঘুরি করছে। পায়ে ঠুকর দিয়ে একটা অন্যটাকে কি যেন বলছে। তারপর দু'একটা চলে যাচ্ছে। আবার দল বেঁধে বন্ধুদের নিয়ে আসছে। দৃশ্যপটটা খুব সুন্দর। মাঝে মাঝে ছোট্ট ব্যাপার গুলো মানুষকে খুব বেশি আনন্দিত করে। আমি নীলাদ্রিকে বললাম দেখো মাছেরও আজকে মেলা বসেছে। মেলার প্রধান আকর্ষণ তোমার পা। কথা শুনে সে হাসলো। তার গজঁদাতটার মায়ায় পরেছি বারং বার। অধর প্রস্ফুটিত হয়ে যখন হাঁসিটা বেরিয়ে আসে তখন মনে হয় দূরে পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসছে স্বচ্ছ শুভ্র ঝর্ণাধারা। আমি তাকিয়ে আছি তার চোখের দিকে, ঢুবে যাচ্ছি তার চোখের গভীরতায়। হঠাৎ আপা রুমে ঢুকলো। কিরে! বই হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস যে। আচমকাই আপাকে জিজ্ঞেস করলাম। এটা কি মাস চলে আপা? কেন! ফেব্রুয়ারী!! কতো তারিখ আজকে? কি হইছে তোর? এই মাস কেউ ভুলে যায়? আমি বললাম, সবার কি সব কিছু মনে থাকে? তোমার কি সব কিছু মনে থাকে? আপা চুপ করে আছে। পাশের ক্যালেন্ডারের দিকে তাকালাম। আজ ১০ ফেব্রুয়ারী, বৃহস্পতিবার (২০২২), ২৭ ফাল্গুন (১৪২৮), ৮ জামিউস সানি-রজব (১৪৪৩)। এই মাসের নাম আপা ভুলে যাওয়ার কথা না। আপার জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম দিনটি এ মাসে। ১৫ ফেব্রুয়ারি তাদের বিয়ের ১৩ বছর পূর্ণ হবে। সুন্দর সময় গুলো কতো তাড়াতাড়ি কেটে যায়। মনে হচ্ছে এই তো সেদিন তাদের বিয়ে হলো। অথচ জীবনের ১৩ টা বছর কাটিয়ে দিয়েছে এই সংসারে। হয়তো বাকি জীবনটাও আপার এভাবেই কেটে যাবে। গতবছর নীলাদ্রিকে কথা দিয়েছি। সামনে বছর থেকে আর ভুল হবে না। রোজ ডে, প্রমিস ডে, ভ্যালেনটাইন্স ডে, ফাল্গুন কোনটা বাদ যাবে না। সে বললো না না, আমার শুধু ভালোবাসা দিবস আর প্রহেলা ফাল্গুন হলেই হবে। দুইটা যেহেতু এটি দিনে সহজে মনে থাকবে। ১৪ই ফেব্রুয়ারির আর তিন দিন বাকি। কি করা যায়? মেয়েটা কে কিভাবে দিয়ে চমকে দেয়া যায়? শাড়ি! চুড়ি! আলতা? না এগুলো দিয়ে অতোটা চমকে দেয়া যাবে না। আসলে আমি তাকে কখনো চমকে দিতে পারিনি। বার বার আমার প্রতি তার ভালোবাসা প্রকাশের ফন্দিফিকির দেখে নিজেই চমকে যাই। মনে পরলো, নীলাদ্রি সব চেয়ে বেশি খুশি হয় তাকে নিয়ে কিছু লিখলে। কিন্তু কি লিখবো! আমিতো কোন কবি-সাহিত্যিক না। ভালো লিখতেও পারি না। তারপরও চেষ্টা করতে দোষ কি! লেখা খারাপ হলে নীলাদ্রি নিশ্চয়ই অপমান করবে না। একটা চিঠিতো অন্তত লিখা যায়। খাতা-কলম নিয়ে বসলাম। একটা লাল-সাদা ফাল্গুনী শাড়ির সাথে চিঠিটা উপহার পাঠাবো। প্রিয় গজদন্তিনী, মাঘের উত্তরীয়তে ঘন কুয়াশা যেভাবে সব কিছু আচ্ছাদন করে রাখে, তোমার ভালোবাসা আমাকে তেমনি ভাবে আগলে রেখেছে। বৃক্ষরাজি যেমন শীতের প্রকোপে পাতা ঝেড়ে হাজারটা নতুন কুড়িঁ নিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়, আমার জীবনে তোমার অস্তিত্ব তেমনি হাজারটা কুড়িঁ হয়ে ফুল ফুটায়। শিউলী ফোঁটা ফাল্গুনের শুভেচ্ছা নিও। জানি না তোমাকে এভাবে আর কতো দিন অপেক্ষা করতে হবে। শুধু জানি একটা স্বপ্নের পিছনে ছুটটি। যে স্বপ্নটা লালন করছি বহুকাল। যে স্বপ্নটা তোমার-আমার-আমাদের। সব কষ্টের বিনিময় হিসাবে তোমাকে আমার করে চাই। ভালোবাসা দিবসে তোমাকে দেয়ার মতো আমার কিছুই নেই। তবু যেটুকু দিলাম স্বযত্নে বরণ করে ভালোবাসা বলেই জেনো। ভালোবাসা কোন দিবসে বন্দী থাকে না, ভালোবাসা কোন উদযাপনে আকটে থাকে না। যে মানুষ ভালোবাসতে জানে, তার কাছে এই দিনটি কেবলই দিবস মাত্র। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তোমায় ভালোবাসি প্রিয়, তবুও বিশেষ দিনে বিশেষ ভালোবাসাটুকু নিও। ইতি, তোমার ভালোবাসা। চিঠি শেষ করে উঠলাম। সকাল থেকে কিছু খাইনি। খেয়ে বের হতে হবে। শাড়ি কিনতে যেতে হবে মিরপুর বেনারসি পল্লীতে। সেখানে সুন্দর তাঁতের শাড়ি পাওয়া যায়। সাদা জমিনের মাঝে মিনাকারী কাজ করা লাল পাড়ের শাড়িতে নীলাদ্রিকে অনিন্দ্য সুন্দর দেখাবে। কয়েকটা দোকান ঘুরে একটা শাড়ি নিলাম। দোকাদারও খুশি। মামা আপনার বয়সী সবাই এসে শাড়ি দেখতে চায়। তারা নিজেরও জানে না তাদের কেমন শাড়ি চাই। হাজার দেখালেও বলে এটা না অন্য ডিজাইন দেখান। কিন্তু আপনি সবকিছু কেমন সুন্দর বলে দিলেন। আমি হাসলাম। সামাল দিয়ে বললাম মামা দেরি হয়ে যাচ্ছে, আজ আসি। বের হয়ে মিরপুর স্টেডিয়াম রোডে হাঁটা ধরলাম । এই রোডে বাহারি রংয়ের চুড়ি পাওয়া যায়৷ কয়েকজন বয়স্ক মহিলা পসরা সাজিয়ে বসে থাকে। বেশি দামাদামির প্রয়োজন হয় না। পছন্দ হলে দশ-বিশ টাকা এদিক সেদিক। একটা পসরার সামনে দাঁড়াতেই খালা বললো কি মামা চুড়ি নিবেন। হু, দেখি নেয়া যায় কিনা। মামা আওগাইয়া আহেন, বইয়া আস্তে ধীরে দেইখা পছন্দ করেন। পছন্দ হইলে কইয়েন। কম দামে দিয়া দিমু। বেচাকিনা নাই। আপনাগো শিক্ষিত করোনা আমাগো জীবনটা পদ্মার ভাঙ্গনের লাহান ভাসাইয়া নিয়া গেছে। করোনা কি শুধু আপনাদের ভাসাইছে, আমাদের ভাসায় নাই? কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। সবাইকে সব কিছু বলতে নেই। সবাই সব কিছু বুঝেও না। যার জীবনে আঘাত আসে, সেই জানে আঘাতের ক্ষত কতোটা। ব্যাগ থেকে শাড়িটা বের করে দেখালাম। এটার সাথে মিলিয়ে লাল আর সাদা চুরি দেখান। খালা শাড়িটা হাতে নিয়ে বললো মামা শাড়িটা খুব সুন্দর হইছে। তারপর খালা নিজেই খুঁজে খুঁজে চার ডজন চুরি বের করে দিলেন। দু ডজন নেয়ার ইচ্ছা থাকলেও, দাম একটু কম ধরে খালা চার ডজন দিয়ে দিলেন। চুড়ি গুলো সত্যি অনেক সুন্দর। তাই আর কিছু না বলে নিয়ে নিলাম। চিঠিসহ সব গুলো একটা প্যাকেটে মুড়িয়ে সুন্দরবন কুরিয়ারে আসলাম। তাদের নির্দিষ্ট ব্যাগে ভরে নাম ঠিকানা লিখে নিলাম। ব্যাগের উপর বড় করে লিখলাম নীলাদ্রির 'উপহার'। কাউন্টারের লোকটা লেখাটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে থাকুক, বুঝে যাক এটা প্রিয় মানুষকে দেয়া ভালোবাসার উপহার। তাতে আমার কি? শুধু এই মন জানে, কতো কথা জমাই রোজ তার নামে।