আমার অনেক দিনের স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে৷ লং জার্নি করব, পাশের সিটে একটি অপরিচিত মেয়ে থাকবে। কেমন এক অনুভূতি! এই অনুভূতি উপভোগ করার একটি ইচ্ছা মনে ছিলো। আজ সেটা পূরণ হতে যাচ্ছে। আর মেয়েটি যদি হয় সুন্দরী তাহলে তো কথাই নেই। আব্দুল্লাহপুর সাকুরা পরিবহনের কাউন্টারে বসে আছি। আমার সিট ছিলো C-4। জানালার পাশের সিট। বাসে লং জার্নি করলে আমার জানালার পাশে বসতেই হবে। নয়ত ভালো লাগে না। একটু আগে কাউন্টারম্যান ভাই রিকোয়েস্ট করে আমাকে C-3 তে ট্রান্সফার করলো। কারণ একটি মেয়ে যাবে ঐ সিটে। মেয়ে বলে আমিও আপত্তি করিনি। রাত দশটার সময় গাড়ি ছাড়লো পটুয়াখালীর উদ্দেশ্যে। গাড়ির সুপারভাইজার ভাই আমাকে জানালার পাশের সিটে বসতে বলল আর আমার পাশের সিটে এক মুরুব্বি চাচাকে এনে বসিয়ে দিলো। এটা দেখে তো আমি থ খেয়ে গেলাম। ভাবলাম কি আর হলো কি! মনেহয় মেয়েটি টিকিট ক্যান্সেল করেছে। কি আর করার, কানে হেডফোন লাগিয়ে বাজিয়ে দিলাম ফুল সাউন্ড... "কিছু স্বপ্ন এনেছি কুড়িয়ে... দেখার আগেই দিলাম উড়িয়ে”। শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গেলাম। সুপারভাইজারের ডাকে ঘুম ভাঙলো। চোখ মুছতে মুছতে তার দিকে তাকালাম। সে বলল, ভাই আপনার সিটে আপনি বসুন। C-4 এর লোক চলে আসছে। দেখলাম পাশেই একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে মাস্ক পড়া। হলুদ বর্ণের মেয়েটি, গায়ের বর্ণ হলুদ সুন্দর সেটা বুঝলাম চোখ ও কপাল দেখে। চোখ দুটো রাগী স্বভাবের, দেখেই বোঝা যায়। খুব বিরক্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সুপারভাইজার আবার বলল, কি হলো ভাই, উঠুন। আমি বললাম, ভাই কোথায় এসেছে বাস? নবীনগর আসছে। আমি উঠে গিয়ে মেয়েটিকে বসতে দিলাম। এসি সার্ভিস বাস। সিট বেশ বড় বড়। আর তাই আমাদের মাঝের দূরত্বটাও বেশ। মেয়েটি সিটে বসে তার সাজুনী ব্যাগ থেকে ইয়ারফোন বের করলো। কানে লাগালো। বাস চলছে তার গতিতে। কি দিয়ে শুরু করব বুঝতেছি না! নিজের অনিচ্ছাকৃত ভাবেই দেহটা তার দিকে হেলে যেতে চাচ্ছে। নিজেকে খুব কঠিন হাতে সামলে নিচ্ছি। এভাবে নিরবতায় সময় কেটে গেলে তো সব কিছু মাটিই রয়ে যাবে। আমার নানা ভাই বলত, জীবনে সুযোগ বার বার আসে না তাই বলি, সুযোগ আসলে হাতছাড়া করা একদম ঠিক নয়। নানা ভাইয়ের কথাটি মনে পড়ে গেল। মনে শক্তি সঞ্চয় করলাম। কিছু একটা জিজ্ঞাস করব। এক্সকিউজ মি, কোথায় যাবেন আপনি? এরকম প্রশ্ন দিয়েই শুরু করা যেতে পারে ভাবলাম। -আপনার কাছে একটি সিগারেট হবে? চিন্তা করলাম কি আর বললাম কি! কথাটি বলেই আমি দাঁতের ফাঁকে জিহ্বা রেখে দাঁত দিয়ে চেপে ধরলাম। মেয়েটি খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমাকে জিজ্ঞাস করল, গোল্ড লিফ সুইচ চলবে? আমি অবাক হতে গিয়েও হলাম না। কারণ, আমার ভার্সিটির অনেক বান্ধবী ছিলো সিগারেট খোর। তো ব্যপার না। আমি বললাম, আমার ফার্মে সব চলে, ফিল্টার থেকে ধোঁয়া বেরুলেই হবে। মেয়েটি একটি সিগারেট বের করে দিলো। সিগারেটটি না জ্বালিয়েই আমি মুখে ধরে টানতে থাকলাম। কারণ, এসি বাসের ভিতর সিগারেট খেতে হলে আগুন ছাড়াই খেতে হবে। মেয়েটি বলল, লাইটার দিবো? আমি বললাম, নো, থ্যাংকস। আপনার নাম কি? -রজনি, রজনিগন্ধা। -আমার নাম পলাশ, নামটা সুন্দর না? সবাই বলে নামটা খুব সুন্দর। পলাশ ফুল, খুব সুন্দর ফুল। আমিও নাকি ফুলের মতই সুন্দর। -তো, পলাশ ফুল, এর পরের স্টেপ কি আপনার? আমার চৌদ্দগুষ্টির হিস্ট্রি জানা, তারপর জমিয়ে আড্ডা মারা, আমার ফেসবুক আইডি, ফোন নম্বর, ইনস্টাগ্রাম। অসহ্য! -আপনি কিন্তু একদম ঠিক বলেন নি, আমি ওরকম ছেলেই না। অনেক দিনের একটি ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছে আজ, তাছাড়া আমার নানা ভাই বলেছিলো সুযোগ বার বার আসে না। তাই একটু ট্রাই করা। -আচ্ছা মানুষ তো আপনি, আপনি আমাকে চিনেন? -চিনব না কেন? আপনি রজনি, রজনিগন্ধা। -চিনেন না, আমি রাগি গন্ধা, জেদি গন্ধা, বদ গন্ধা আরো কিছু জানতে চান? পরিবেশ পরিস্থিতি মোটেই অনুকূলে নয়। ঝড়ের বেগ নিমিষেই বেড়ে যাচ্ছে। তুফানটা ভালো করেই তুলতে হবে। তুফানের তীব্রতা অধিক হলে পুরানো স্থাপনা ভেঙে গড়ে উঠতে পারে নতুন সাম্রাজ্য। আমি বললাম, টাইম পাস করার জন্য যদি দু'জনে গল্প করি তো কি এমন ক্ষতি? খুব বিরক্তের তীব্রতায় মুখের মাস্ক খুলে ফেলল গন্ধা, আমার দিকে তাকালো। যাই হোক, চাঁদ মুখখানি দেখলাম। অনিচ্ছাকৃত ভাবেই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো, মাশাল্লাহ! তুমি তো দেখছি পরি গন্ধা। আল্লাহর কি অপূর্ব সৃষ্টি! আমি অবাক তোমার চাঁদ মুখ দেখে! -এই যে পলাশ ফুল, মিস্টার হাফ লেডিস। কি সমস্যা আপনার? আপনার মত একজন হাফ লেডিসের সাথে গল্প করব? হাউ পসিবল? আমি আপনাকে লাস্ট অর্নিং দিচ্ছি, আর একটি কথাও যেনো আপনার মুখ থেকে বের না হয়৷ যদি হয় তো, এর পরের সিন আরো ভয়ংকর হবে সেটা আপনার নিতে খুব বেগ পেতে হবে। কে যে বলেছিল, প্রশংসা করলে মেয়েদের মন নরম হয়ে যায়! গুগলে সার্চ করে নিয়ে আসব তাকে। তারপর দেখিয়ে দিবো এই রাগি গন্ধাকে। কত সুন্দর প্রশংসা করলাম, আমার নিজের কথায় আমি নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেছি অথচ কি রিপ্লে দিলো! আমি হাফ লেডিস! এ রাগ কই রাখবো! যাই হোক আর কথা হলো না আপাতত। আমার এক ফ্রেন্ড বলছিলো, প্রেম করতে হলে বেহায়া হতে হয়। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আমার দারা আর বেহায়া হওয়া সম্ভব নয়। সত্যি বলতে, গন্ধাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। কিন্তু ও এত রাগি কেন? গন্ধা ঘুমিয়ে গেলো আর আমিও। হঠাৎ গন্ধার চুলের গন্ধে আমার ঘুম ভাঙলো। খেয়াল করে দেখলাম আমার কাঁধে মাথা রেখে শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে। অচেনা এক অনুভূতিতে ছেয়ে গেলো আমার জরাজীর্ণ শহরটা। মনে পড়ে গেল বাংলা সিনেমার সেই গানটা, "ঘড়ির কাঁটা থাক থেমে থাক... সুখের সময় এসেছে"। আমিও চুপ হয়ে ঘুমের ভান ধরে রইলাম। চাইনা এ সুখটা অল্পতেই হারিয়ে যাক। কিন্তু একটা কথা আছে, "গরীবের পেটে ঘি হজম হয়না"। আমার বেলায় মোটেই তার ব্যাতিক্রম হয়নি। তবে গন্ধা ভাবলো, এসবের কিছুই আমি টের পাইনি। পটুয়াখালীর আগে পাগলা নামক একটি জায়গা আছে। সেখানে গন্ধা আর আমি দু'জনেই বাস থেকে ল্যান্ড করলাম। বাস থেকে নামার সময় বার বার গন্ধা সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছিলো আর আমি রহস্যের দৃষ্টিতে। আমি আর গন্ধার লক্ষ ফলো না করে একটি রিকশা নিয়ে বাসায় চলে আসলাম। বাসায় এসে ব্যাগটা রেখে ওয়াস রুমে গেলাম ফ্রেস হওয়ার জন্য। ওয়াস রুম থেকে বের হয়েই বরাবরের মত খাবার টেবিলে চলে গেলাম। আমি ঢাকা থেকে বাড়ি আসলেই মা আমার জন্য টেবিলে খাবার রেখে পাশে বসে থাকে। আমি খাই আর মা আমার সাথে বিভিন্ন কথা বলে। কেমন ছিলাম, আসতে কষ্ট হলো নাকি ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আজ টেবিলে খাবার আছে কিন্তু মা নেই। বাসার সামনে হালকা হইচই শুনতে পেলাম। বাসায় অনাকাঙ্ক্ষিত নতুন মেহমান আসলে যেমনটা হয়। আমি মুখ মুছতে মুছতে সামনে গেলাম। দেখলাম সেই রজনিগন্ধা! আমি তো থ খেয়ে গেলাম। এই মেয়ে এখানে কেন? আর তাকে নিয়ে এত হইচই বা কিসের? এরই মধ্যে আমার চোখে গন্ধার চোখ দু'খানা আটকে গেলো। দু'জনেই থেমে গেলাম। ও অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর আমিও। স্লো মোশনে হাতের আঙুল আমার দিকে তাক করে আমার মায়ের দিকে তাকালো। আমার মা হাসি দিয়ে বলল, ও আমার একমাত্র পাগল ছেলে পলাশ। তোমার সাথে ওর দেখা হয়নি। আগে যখন তুমি এসেছিলে তখন ও কক্সবাজার ঘুরতে গেছিলো বন্ধুদের সাথে। এসে যখন শুনলো, তোমরা এসেছিলে তখন খুব আপসোস করেছিলো। তোমরা কি এক বাসেই এসেছ? আমি বললাম, শুধু এক বাসে না এক সিটে এসেছি। মা হাসি দিয়ে বলল, না চিনলে যা হয়। চলো মা ঘরে চলো। টেবিলে নাশতা রেডি আছে ফ্রেস হয়ে খেয়ে নাও। পড়ে তোমার সব কথা শুনবো। গন্ধা আমার মামাতো বোন। একটু দূর সম্পর্কের। মায়ের মামাতো ভাইয়ের মেয়ে। বছর চারেক আগে একবার আমাদের বাড়িতে ফ্যামিলি সহ বেড়াতে এসেছিলো কিন্তু তখন আমি বন্ধুদের সাথে কক্সবাজার। তাই দেখা হয়নি। গন্ধার সাথে আলোচনার মাধ্যমে জানতে পারলাম, ওর বাবা ওর অপছন্দের পাত্রের সাথে বিয়ে ঠিক করেছিলো আর তাই বাসা থেকে পালিয়েছে। এখন ও আমার একজন ভালো বন্ধু কিন্তু আমি ওকে ভীষণ ভালোবাসি। গল্পঃ #রজনিগন্ধা রবিউল ইসলাম রাফি