বাবার সাথে আমার বেশ একটা সখ্যতা হয়ে উঠেনি। চাকরির সুবাদে বাবা ঢাকাতে থাকতেন আর আমরা সপরিবারে বাড়িতেই থাকতাম। দু'মাস তিন মাস পরে বাড়ি আসতেন দু'চার দিনের জন্য। বাবা বাড়িতে আসলেই আমার যেনো বিপদ শুরু হয়ে যেতো। মা'কে চুপি চুপি জিজ্ঞেস করতাম বাবা কবে চলে যাবেন। বাবা চলে গেলেই যেনো বেঁচে যেতাম আমি। এর পিছনে কারণ আছে। কারণ হলো, বাবা ছোট বেলা থেকেই কেমন একটা দূরে সরিয়ে রেখেছেন আমাকে। আমি যা করতাম সব কিছুতেই তার রাগ শুনতে হতো। চোখ গরম দিতেন বেশি বেশি। আমার মনে পড়ে, ছোট বেলা একবার ঢাকা বাবার কাছে বেড়াতে গিয়েছিলাম। বাবার সাথে ঘুরছিলাম বেশ কিছু জায়গা। তখনও রাগ শুনেছি বাবার। আমি হাঁটার সময়ও বলত, এভাবে কেউ হাঁটে? ভালো ভাবে হাঁটতে জানস না। আসলে কেমন করে হাঁটতে হবে জানা ছিলো না আমার। অথবা বাবার ভয়েই হয়ত হাঁটা ভালো ভাবে হচ্ছিলো না। আমার মনে পড়ে না বাবা কোন দিন আমার গায়ে হাত তুলেছেন কিন্ত মা আমাকে অনেক মেরেছেন। সর্বশেষ নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় মায়ের হাতের মার খেয়েছিলাম। যাই হোক বাদ দেই সে কথা। বাবা রাগ দিতেন বলে যে ভালোবাসতেন না বা কম ভালোবাসতেন তেমন কিন্তু নয়। বাবা প্রচুর ভালোবাসেন আমাকে। একবার অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় হাডুডু খেলতে গিয়ে আমার হাত ভেঙে যায়। স্থানীয় চিকিৎসা কেন্দ্রে চিকিৎসা করানোর পর আমাকে বাড়ি আনা হয়। ফোনের মাধ্যমে বাবাকে খবর দেয়া হয়। তখন সবার হাতে মোবাইল ছিলো না তবে আমাদের একটা ছিলো। যাইহোক পরদিন খুব সকাল সকাল আমাকে নিয়ে বরিশাল যাওয়া হয়। ওখানে একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ঐ দিনই বিকেল তিনটার দিকে আমার অপারেশন হয়। বাবা আসতে আসতে রাত ন'টা বেঝে গিয়েছিলো কিন্তু তখনও আমার জ্ঞান ফিরেনি। আমি খুব ভয়ে ছিলাম। ভাবছিলাম বাবা আমাকে খুব বকবে। আমার জ্ঞান ফিরলো রাত তিনটার দিকে। চোখ খুলেই মা'কে জিজ্ঞাস করলাম, বাবা এসেছে? মা উত্তর দিল হ্যাঁ আসছে। ঐ তো তোর বাবা। বাবাকে দেখিয়ে বলল। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালাম। দেখলাম বাবার চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত। আমাকে জড়িয়ে ধরতে পারলে হয়ত বাবার বুকটা জুড়াতো তখন। আমার এমনটা মনে হলো। কিন্তু আমাকে তো আর নাড়াচাড়া করা যাবে না। ঐ দিন বাবা আমাকে একটিও বকা দিলেন না। সেদিন আমি বুঝতে পেরেছিলাম বাবা আমাকে কতখানি ভালোবাসে। বাবার সাথে আমি আজও ফ্রী হতে পারিনি। বাবার সাথে আমার ফোনে কথাও খুব কম হয়। তিন চার দিন পর পর চার পাঁচ মিনিট। তাছাড়া প্রয়োজন হলে তো যোগাযোগ হয়েই থাকে। কিন্তু যখনই দেখি কোন বাবা-ছেলের মাঝে খুব বন্ধুত্ব তখনই আমার হৃদয়টা কেঁদে উঠে। কেন আমার বাবার সাথে আমার এমন একটা সম্পর্ক হলো না! কেন আমার মনের সব কথাগুলো নিঃসংকোচে বাবাকে বলতে পারিনা! শুনেছি সেই সময়ের অধিকাংশ বাবারা নাকি নিজেদের সন্তানদের কোলে নিতে লজ্জা পেতো। আদর করতে লজ্জা পেতো। হয়তোবা সেই লজ্জার কারণেই বাবা আমাকে কাছে কম টেনেছেন। যাতে নষ্ট হয়ে না যাই তাই বেশি বেশি শাসন করেছেন। এই জন্যই বাবার মাঝে আর আমার মাঝে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এটা আমার উপরে একটা খারাপ প্রভাব ফেলেছে। এটা আমি বুঝতে পেরেছি। আমি আজও চেষ্টা করে যাচ্ছি বাবার সাথে আমার দূরত্ব শূন্যের কোথায় আনতে। আজ আমিও বাবা! আমার ছেলের সাথে আমার বেশ বন্ধুত্ব। ও আমাকে ছাড়া ঘুমাতে পারে না। আমার সাথে ওর খেতে ভালো লাগে। আমার সাথে ওর খেলতে ভালোলাগে। আমি ওকে পড়ালে অনেক্ষণ পড়তে পারে। আমার সাথে ওর বাহিরে বেড়াতে ভালো লাগে। ওর যত আবদার আমার কাছে। প্রতিনিয়ত ওর মায়ের নামে অভিযোগ দিয়ে থাকে। বাবা, মা এটা করেছে, ওটা করেনি, আমাকে মেরেছে, ধমক দিয়েছে, গোসল করিয়ে দেয়নি, ওটা খেতে চেয়েছি কিনে দেয়নি। ওর ছোট ছোট অভিযোগগুলো আমি গুরুত্ব দেই। অন্যায় কিছু আবদার করলে বোঝাই। আমার কথা ও বুঝে। আমি নিষেধ করলে শোনার চেষ্টা করে। শুধু শাসন করে আর যুদ্ধ করেই জয়ী হওয়া যায় না। ভালোবাসা দিয়েও জয়ী হওয়া যায়। ভালোবাসা নিজের ভিতরে চাপিয়ে না রেখে সেটার বহিঃপ্রকাশ করতে হবে। শাসনও করতে হবে তবে সেটা অতিরিক্ত নয়। অতিরিক্ত শাসন অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষতির কারণ হতে পারে। বাবা তোমাকে অনেক ভালোবাসি আমি। কিন্তু আজও সেটা তোমার কানে কানে বলতে পারলাম না। জানিনা জড়তা কেটে কোনদিন বলতে পারব কিনা! অনুগল্পঃ #আমার_বাবা রবিউল ইসলাম রাফি ১০.০২.২০২২