স্কুলে ছোট একটা পোস্টে চাকুরি করেন আমার বাবা ৷ প্রতিদিন সকালে ভাঙ্গা একটা সাইকেল নিয়ে ১০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে যাওয়া-আসা করেন তিনি ৷ উনার অনেক বয়স হয়েছে ৷ আমি জানি বাবার কতোটা কষ্ট হয় সাইকেল চালাতে ৷ তার অনেকদিনের শখ বাইক কিনার, কিন্তু উনি কিনতে পারেন না কারন, সাত জনের বড় পরিবার আমাদের । বাবার চোখে অনেকদিন ধরে সমস্যা, তিনি বারবার বলেন চোখের ছানি কাটাতে হবে । ইদানিং চশমাতেও তিনি খুব বেশি দেখতে পারেন না । ওইদিকে আমি তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটি তে ফাইনাল ইয়ারের লাস্ট সেমিস্টারে পড়ছি । একটা ল্যাপটপের খুব প্রয়োজন । বাবাকে বললাম বাবা একটা ল্যাপটপ কিনতে হবে । বাবা বললেন এমাসে তো একটু সমস্যা, পরের মাসে তোমাকে ল্যাপটপ কিনে দেবো । জানতাম বাবা চোখের ছানি অপারেশন করার জন্য টাকা জমাচ্ছিলেন । সেদিন সকালে আমার মাত্র ঘুম ভেঙেছে, শুনতে পেলাম বাবা মাকে বলছে মনোয়ারের মা, ছানি অপারেশনের টাকাটা নিয়ে আসো তো, মা বললেন কেন কি করবেন? বাবা বললেন , মনোয়ারকে দেবো ল্যাপটপ কিনার জন্য । আব্দুল হালিম সাহেবের কাছ থেকে আরো 20 হাজার টাকা ধার নিয়েছি, আস্তে আস্তে উনাকে শোধ করে দেব । আর আমার ছানি অপারেশন করানোর জন্য 10 হাজার টাকা জমেছে । মোট 30000 টাকা দিয়ে মনোয়ার একটা ল্যাপটপ কিনুক । মা বললেন আপনার ছানি অপারেশনের কি হবে ?বাবা বললেন একটা আশ্চর্য বিষয় হয়েছে তোমাদের বলিনি । ইদানিং আমার চোখে দেখতে কোন সমস্যা হচ্ছে না । সব কিছুই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি । আমি বেড থেকে উঠে গিয়ে বাবাকে বললাম না বাবা , আমার ল্যাপটপ লাগবে না, তুমি ছানি অপারেশনটা করাও । বাবা বললেন, ধুর পাগল আমার চোখে এখন কোন সমস্যা নেই । আমি সব পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি । রাজা ডাক্তার কি একটা ড্রপ দিয়েছে , সেই ড্রপ চোখে দেওয়ার পর আমি চোখে ভালো দেখতে পাচ্ছি । বাবার কথা বিশ্বাস করে টাকাটা নিলাম । সেদিন হলের বেডে শুয়ে ছিলাম, হঠাৎ মায়ের কল আসলো, মা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন জানিস তোর বাবা আজ মরতে মরতে বেঁচে গেছেন । আমি বললাম কি বল মা ! কি হয়েছিল ? মা বললেন তোর বাবা আজ ট্রাকের নিচে পড়তে যাচ্ছিলেন, উনি তোকে মিথ্যে বলেছিলেন যে, উনার চোখের সমস্যা ঠিক হয়ে গেছে । না! উনার চোখের সমস্যা বেড়ে গেছে । আজ যখন উনি সাইকেল নিয়ে স্কুল থেকে ফিরছিলেন , তিনি চোখে কিছু দেখতে না পেয়ে ট্রাকের নিচে পড়তে যাচ্ছিলেন । আল্লাহর অশেষ রহমতে, ট্রাক ড্রাইভার শেষ মুহূর্তে ট্রাকের ব্রেক কষতে পেরেছিলেন । আল্লাহ বাঁচিয়ে দিয়েছেন উনাকে । তুই বাড়ি আয় বাবা, যে করেই হোক তোর বাবার চোখের ছানির অপারেশনটা করাতে হবে । আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল, কত কষ্ট করেন বাবা আমাদের জন্য । নিজের জীবনটাও দিয়ে দিচ্ছিলেন আমার জন্য । বাড়ি ফিরে বাবাকে খুব বকে ছিলাম, আর বলেছিলাম বাবা পৃথিবীতে অন্য কিছু বড় নেই তুমি ছাড়া । কেন তুমি আমার সঙ্গে মিথ্যে বললে ? কেন ? কেন ?কেন ? আমি ল্যাপটপ বিক্রি করে তোমার অপারেশন করাবো । বাবা বললেন না রে বোকা সামনের মাসে আমি টাকা পাবো ,তারপর অপারেশন করাবো, বাবা আমাকে ল্যাপটপ বিক্রি করতে দিলেন না, সামনের মাসেই উনার ম্যানেজ করা টাকা দিয়ে একটা চোখের অপারেশন করানো হলো । ডাক্তার বলেছিলেন যে, তার দু'চোখের অবস্থায় খুব খারাপ । দুই চোখেরই অপারেশন করাতে হবে । বাবা বললেন, সমস্যা নেই আপাতত একটা করাই , আরেকটা পরে করবো । বাবার বাঁকি চোখটা এখনো অপারেশন করানো হয়নি । কবে করানো হবে একমাত্র আল্লাহই জানেন । এদিকে আমাদের মাটির বাড়িটা ভেঙে পড়তেছে, নতুন বাড়ি তৈরি করতে হবে । বাবা এখন তার চোখের অপারেশনের চিন্তা বাদ দিয়েছেন । তার এখন একটাই ভিশন, তার ভালবাসার মানুষ তথা আমাদের জন্য কিভাবে একটি নতুন বাড়ি তৈরি করবেন !